ঢাকাই সিনেমায় নায়ক রাজ একজনই। তিনি হলেন নায়ক রাজ রাজ্জাক। তিনি বাংলা চলচ্চিত্রকে অসংখ্য ব্যবসা সফল সিনেমা উপহার দিয়েছেন। দেশের দর্শককে করেছেন হলমুখী। আজও তার সিনেমা মানুষকে সাদাকালো যুগে ফিরিয়ে নিয়ে যায়।আজ ২৩ জানুয়ারি বাংলা সিনেমার কিংবদন্তি নায়ক রাজ্জাকের জন্মদিন। তার জন্মদিনে দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে কথা বলেছেন কবরী, সোহেল রানা, আলমগীর, ববিতা এবং গাজী মাজহারুল আনোয়ার।রাজ্জাক-কবরীর মতো জুটি আর হবে কিনা বলা কঠিন: কবরীরাজ্জাক সাহেব আর আমি অনেকদিন একসঙ্গে কাজ করেছি। দীর্ঘদিনের সহকর্মী আমরা। কাজেই এমন একজন প্রিয় সহকর্মীকে হারানোর কষ্ট আছে, সেটা থাকবেই।সবচেয়ে বড় কথা একসঙ্গে কাজ করতে গিয়ে আমাদের দুজনের মধ্যে ভালো বন্ধুত্ব হয়েছিল। সেই বন্ধুত্ব সব সময়ই ছিল। এদিক থেকে বলব, ভালো একজন বন্ধুকে হারিয়েছি। নায়ক নয়-বন্ধুত্বটাও কম বড় নয়।লোকে বলত, রাজ্জাক-কবরীর বিয়ে হলে ভালো হত। যেমনটা বলত উওম সুচিত্রার বেলায়। এসব ছিল মানুষের ভালোবাসার প্রকাশ। সেখানে আমাদের করার কিছু ছিল না।কিন্তু রাজ্জাক এবং আমি দুজনেই বিবাহিত ছিলাম। তবুও লোকে বলত।কেন বলত? পর্দার জুটি হিসেবে সফলতা পেয়েছিলাম বলেই বলত। আমাদের দুজনার কেমিস্ট্রি দর্শক গ্রহণ করেছিলেন। ভালো কেমিস্ট্রি গড়ে উঠেছিল আমাদের। অনেক হিট সিনেমা আছে দুজনের। যার সঙ্গে বাস্তবের কোনো মিল ছিল না।জুটি প্রথা আর জনপ্রিয়তায় আমরা অনেক শীর্ষে পৌঁছেছিলাম। রাজ্জাক-কবরীর মতো জুটি আর হবে কিনা বলা কঠিন।আমরা জুটি হিসেবে মানুষের এতো ভালোবাসা পেয়েছিলাম, যা সত্যিই ভাগ্যের ব্যাপার। ভাগ্য আমাদের সহায় ছিল। এ ছাড়া, আমরা পরিশ্রমও করেছিলাম খুব। কাজের প্রতি সততা ও ভালোবাসা ছিল ভীষণ রকমের।আমরা মানুষকে ভালোবেসেছি, মানুষ আমাদের ভালোবাসা দিয়েছে।নায়ক রাজ রাজ্জাকের অভাব আজও অনুভব করি: সোহেল রানানায়ক রাজ রাজ্জাকের অভাব আজও অনুভব করি, আগামীতেও করব। বাংলাদেশের সিনেমা যতদিন থাকবে ততদিন তাকে মনে রাখতে হবে। চলচ্চিত্রের আকাশে আজীবন তিনি নক্ষত্র হয়ে জ্বলবেন।নায়ক হিসেবে তিনি ছিলেন অহংকার করার মতো।হাঁটি হাঁটি পা করে তিনি সিনেমায় কাজ শুরু করেন। শুরুতে ছোট ছোট চরিত্রে অভিনয় করেছেন। শেষে নায়ক হিসেবে ক্যারিয়ার গড়েন। যেভাবে তিনি দিনরাত পরিশ্রম করে নিজের ক্যারিয়ার গড়েছেন এবং বাংলা সিনেমাকে অনেক উচ্চতায় নিয়ে গেছেন, তার তুলনা তিনি নিজেই। এ কারণে তাকে আমি অনেক সম্মান ও শ্রদ্ধা করি।তার হাত ধরে আরও নায়ক-নায়িকা আমাদের সিনেমায় এসেছেন। তারাও প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। নতুন নায়ক-নায়িকাদের জায়গা দেওয়ার ব্যাপারে তিনি সব সময় পজিটিভ ছিলেন। এ কারণে তার প্রতি সবারই শ্রদ্ধা আছে এবং থাকবে।একটি কথা আরও জোর দিয়ে বলতে চাই, তার অভাব কখনো পূরণ হওয়ার নয়।রাজ্জাক সাহেবের আলাদা একটা ইমেজ ছিল। এটা আর কারো নেই। সিনেমা শিল্পের সবাই তাকে সম্মান করতেন, ভালোবাসতেন। তিনি কোনো কথা বললে তার বিপরীতে কেউ কখনো কিছু বলতেন না। নিজেকে এতটাই উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি।আমার প্রথম সিনেমা মাসুদ রানাতে তাকে একটি অনুরোধ করেছিলাম। একটি গানের সঙ্গে তাকে কাজ করতে বলেছিলাম। আমি তখন নতুন। আর তিনি অনেক বড় স্টার। কিন্তু, তিনি আমার অনুরোধ রেখেছিলেন। এতো বড় উদারতা সবাই দেখাতে পারেন না।অন্যদিকে বাবা হিসেবে বা স্বামী হিসেবেও তিনি যা করে গেছেন, এটাও সবাই করতে পারেন না।দূর থেকে এখনো তাকে মনে করি, সম্মান করি।তার তুলনা কারো সঙ্গে হয় না: আলমগীরনায়ক রাজ্জাককে খুব মিস করি। ভীষণভাবে মিস করি। জন্মদিন এলে আরও বেশি মিস করি। তার তুলনা কারো সঙ্গে হয় না। এমনই একজন নায়ক ছিলেন তিনি।বাংলাদেশের সিনেমা তার কাছে চির ঋণী হয়ে থাকবে। যতদিন সিনেমা শিল্প এদেশে থাকবে ততদিন তার কথা স্মরণ করবে কৃতজ্ঞতার সঙ্গে। এই ঋণ শোধ হওয়ার নয়। কেননা ঢাকাই সিনেমাকে তিনি একাই বহুদূর টেনে নিয়ে একটা উচ্চতায় দাঁড় করিয়েছিলেন।এক সময় হিন্দি ও উর্দু সিনেমার বাজার ছিল। নায়ক রাজ্জাক তার অভিনীত সিনেমা দিয়ে সেই ধারাকে ভাঙেন। বাংলা সিনেমার দর্শককে প্রচণ্ডভাবে হলমুখী করেন।তার পরিবার এবং আমার পরিবারকে কখনো দুই পরিবার মনে হয়নি। একটি পরিবার মনে করেছি সবসময়। এখনো তাই মনে করি। এখনো তার পরিবারের সঙ্গে আমার ভালো যোগাযোগ আছে।আমি যেমন তার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখি, তারাও রাখেন।একজন নায়ক রাজ্জাকের মত শিল্পী আর পাব না। তিনি যেখানে আছেন, ভালো থাকুন, শান্তিতে থাকুন। এটাই চাওয়া।রাজ্জাক একটি ইনস্টিটিউট: ববিতানায়ক রাজ্জাক সম্পর্ক একটি কথাই জোর দিয়ে বলব- তিনি শ্রেষ্ঠ, শ্রেষ্ঠ এবং শ্রেষ্ঠ নায়ক। রাজ্জাক একটি ইনস্টিটিউট। ঢাকাই সিনেমায় তাকে কেউ ছাড়িয়ে যেতে পারেনি। সেজন্য তিনি শ্রেষ্ঠ নায়ক।কেবল জন্মদিন এলে নয়, তাকে স্মরণ করি সব সময়।জহির রায়হান সাহেবের হাত ধরে রাজ্জাক ভাই সিনেমায় এসেছিলেন। আমিও জহির রায়হানের হাত ধরেই সিনেমায় এসেছিলাম।আমরা একটি পরিবারের মতো ছিলাম। কখনোই তার পরিবারের সদস্যর বাইরের কেউ মনে হয়নি। তাকেও সব সময় আমার পরিবারের সদস্য মনে করেছি। তার পরিবারের প্রত্যেকটি সদস্যর সঙ্গে আমার সুন্দর সম্পর্ক।যখন দেশে একবার বা দুইবার বড় বন্যা হয়েছিল, রাজ্জাক ভাই ভাবিকে নিয়ে আমার বাসায় এসেছিলেন খোঁজ নিতে। কত বড় মন থাকলে এটা করতে পারেন।এখনো ভাবীর সঙ্গে মাঝে মাঝে কথা হয়। করোনাকালে বেশ কয়েকবার তিনি আমার খোঁজ নিয়েছেন। আমিও নিয়েছি।রাজ্জাক সাহেবের এক ছেলে কানাডায় আছেন। তার সঙ্গেও যোগাযোগ আছে আমার।এসব থেকেই মনে করি আমরা দুই পরিবারই একই পরিবারের মতো।রাজ্জাক এর শেষ জন্মদিনে আমি তার বাসায় গিয়েছিলাম। অনেক সময় ছিলাম। অনেক গল্প করেছিলাম। ভাবির হাতের রান্না করা খাবার খেয়েছিলাম একসঙ্গে।কাজেই রাজ্জাককে কি ভুলা যায়? তাকে মনে করি সবসময়।রাজ্জাককে খুব মনে পড়ে: গাজী মাজহারুল আনোয়ারকত গল্প, কত স্মৃতি জমে আছে একজীবনে নায়ক রাজ রাজ্জাককে ঘিরে। সেসব কথা যেমন এই বয়সে এসে মনে পড়ে, তেমনভাবে নায়ক রাজ্জাককেও খুব মনে পড়ে। এমন একজন কাছের মানুষকে মনে না পড়ার কোনো কারণ নেই।তার সঙ্গে ছিল বহু বছরের সম্পর্ক। একটি দীর্ঘ জীবন তিনি সিনেমার সঙ্গে কাটিয়েছিলেন, আমিও। শুরুতে তার অভিনীত অনেক হিট সিনেমায় গান লিখেছিলাম আমি। তখন থেকেই আমাদের সম্পর্কের গভীরতা বাড়তে শুরু করে।আবার আমার পরিচালনায় রাজ্জাক প্রথম অভিনয় করেছিলেন শর্ত সিনেমাতে। তার সঙ্গে শবনমসহ আরও অনেকেই ছিলেন। আমার পরিচালনায় কাজ করতে গিয়ে বুঝেছিলাম রাজ্জাক আসলেই জাত শিল্পী ছিলেন। তার মেধা ছিল অনেক। আবার নিজেকে ভাঙার জন্য অসম্ভব পরিশ্রম করতেন।এরপর স্বাক্ষর নামে একটি সিনেমা করি রাজ্জাককে নিয়ে। শাবানাসহ আরও অনেকেই ছিলেন স্বাক্ষর সিনেমায়। সেটে অন্য রাজ্জাককে দেখতাম। সেটে তিনি শিল্পী। শতভাগ শিল্পী মনোভাব নিয়ে কাজ করতেন। কাজটাকে এতোটাই গুরুত্ব দিতেন।কাজের বাইরে অবসরে আবার অন্য রাজ্জাক। তখন তার সঙ্গে মন খুলে আড্ডা দিতাম।শুধু এটুকু বলব, একজন নায়ক রাজ রাজ্জাক হতে অনেক সময় লেগেছিল। এজন্য তার সততা ও পরিশ্রম ছিল। এ কারণেই এদেশের সিনেমায় তার নাম উচ্চারিত হবে জোরেশোরে।
Leave a Reply