ভূমধ্যসাগরের গ্রীস এবং সাইপ্রাস উপকূলে তুরস্কের তেল গ্যাস অনুসন্ধানকে কেন্দ্র করে ব্যাপক উত্তেজনা দেখা দিয়েছে। রীতিমতো যুদ্ধাবস্থা তৈরি হয়েছিল। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী তুরস্ক সঠিক অবস্থানে থাকলেও ফ্রান্স এবং যুক্তরাষ্ট্র গ্রীস-সাইপ্রাসের পক্ষে অবস্থান নেয়ায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রেণের বাইরে চলে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়। তবে এ যাত্রায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ‘দাঁতভাঙা’ জবাব দিয়েছে তুরস্ক। কাজে আসেনি গ্রীস, সাইপ্রাসের কোনো কৌশল।গত সপ্তাহে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র মরগান আর্টগাস এক বিবৃতিতে বলেছিলেন, ‘আমরা তুরস্ক এবং গ্রীসকে অনতিবিলম্বে একটি আলোচনার মাধ্যমে এ সমস্যা সমাধানের জন্য বলেছি।’ যদি এ উত্তেজনার শুরু থেকেই তুরস্ক আলোচনার কথা বলে আসছিল আর গ্রীস তা প্রত্যাখ্যান করেছে। তবে, মরগান তার বিবৃতিতে তুরস্ককে ঈঙ্গিত করে বলেন, জবরদস্তি, দখল, হুমকি, হামলা এ অঞ্চলে কোনো শান্তিপূর্ণ সমাধান বয়ে আনবে না।’এ বিষয়ে জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাইকো মাশ বলেন, ‘আঙ্কারাকে অবশ্যই উস্কানি দেয়া বন্ধ করতে হবে। যদি তারা আলোচনায় বসতে চায়। একই সঙ্গে জার্মানির চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মর্কেল ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং তুরস্কের সঙ্গে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের রাজনৈতিক অস্থিরতা নিরসনে কাজ করছেন। তবে এই উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রীর তুরস্ক সফর স্থগিত করা হয়। এ বিষয়ে মাশ বলেন, ‘ সাম্প্রতিক ঘটনায় আমি অত্যন্ত অবাক হয়েছি। আমার সফর পর্যন্ত স্থগিত করতে হচ্ছে।’এদিকে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিক্রিয়ার প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে তুরস্ক তেল গ্যাস অনুসন্ধানের মেয়াদ বৃদ্ধির ঘোষণা দেয়। বিতর্কিত ওই অনুসন্ধানটি গ্রীসের উপকূলে করা হচ্ছে। যদিও এর মালিকানা দাবি করে আসছে দু’দেশই। তবে ইউরোপীয় গণমাধ্যমগুলো দাবি করে ২৭ সেপ্টেম্বর তুরস্কের ওই অনুসন্ধান শেষ করার কথা ছিল। এ লক্ষে অনুসন্ধানী দল তাদের কার্যক্রম গুটিয়ে সাগর থেকে ফেরত যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। তবে, প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের ‘অন্য পরিকল্পনা’ থাকায় অনুসন্ধান চলমান রাখা হয়।ফ্রান্স বহুদিন যাবত বলে আসছে তুরস্ক বিতর্কিত এলাকায় অনুসন্ধান বন্ধ না করলে তাদের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক ও অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা দেয়া হবে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন গত সপ্তাহে এ হুঁশিয়ারির কথা আরেকবার এরদোয়ানকে স্মরণ কয়ে দিয়েছে। কিন্তু সম্প্রতি ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেতারা গত শুক্রবার এক সম্মেলনে মিলিত হন। সেখানে তুরস্ককে চাপ দেয়া বা কোনো ধরনের নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি উঠে আসেনি। তবে ইইউ’র সদস্য দেশ গ্রীস বিষয়টি আলোচনার টেবিলে তোলার জন্য নানা চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়।ওই সম্মেলনে ইইউ কঠোর বিবৃতি দিলেও গ্রীসকে বলেছে তুরস্কের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা নিয়ে আলোচনার জন্য ডিসেম্বরে ইইউ’র পরবর্তী সম্মেলনের জন্য অপেক্ষা করা উচিৎ। এর কারণ হিসেবে দেখা হচ্ছে, ইউরোপের দেশ জার্মানি, স্পেন, ইতালি, মাল্টা এবং হাঙ্গেরির শরণার্থী বিষয়ক বিরোধ। কারণ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলে তুরস্ক এ সব দেশে আরও শরণার্থী পাঠানো শুরু করবে। এ স্নায়ুযুদ্ধে পর্দার আড়াল থেকে খেলছে ফ্রান্স এবং তুরস্ক। এতে ফ্রান্স খানিকটা এরদোয়ানের খেলার পুতুলে পরিণত হচ্ছে।লাখ লাখ সিরিয় শরণার্থীকে এরদোয়ান কূটনীতির টেবিলে বড় অস্ত্র হিসেবে এবারই প্রথম ব্যবহার করছেন যে তা নয়। সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ শুরুর পর শরণার্থীদের ঢল নামে ইউরোপ অভিমুখে। তখন থেকেই উইরোপীয় দেশগুলোতে প্রবেশদ্বার হিসেবে বিবেচিত তুরস্ক এ সুযোগ কাজে লাগাতে শুরু করে। তুরস্কের সঙ্গে শরণার্থী বিষয়ক চুক্তির সব শর্ত পূরণ করতে ব্যার্থ হয়েছে ইইউ। তাই ভূমধ্যসাগর, কৃষ্ণ সাগর (আটলান্টিক মহাসাগরের একটি প্রান্তীয় সাগর। ইউরোপ ও এশিয়ার মধ্যবর্তী সীমান্ত এলাকা (ককেসাস) এবং ভূমধ্যসাগর ও এজিয়ান সাগর এবং নানা প্রণালীর মাধ্যমে আটলান্টিক মহাসাগর-এর সাথে যুক্ত)-এ তুরস্ককে থামানোর উদ্যোগ নিলেই এরদোয়ান ‘শরণার্থী অস্ত্র’ হাতে তুলে নিচ্ছেন।তবে, তুরস্কের বিরুদ্ধে ডিসেম্বর পর্যন্ত নিষেধাজ্ঞা না দেয়ার সিদ্ধান্তের সঙ্গে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের গভির সম্পর্ক রয়েছে। এদিকে ইউরোপের নেতারা বিশ্বজুড়ে কে কোন দেশের প্রেসিডেন্ট হবেন সেটি নিয়ে একটা সিদ্ধান্ত দিয়ে থাকেন। এবং সেটি বাস্তবায়নে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করে থাকেন। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বেলায় এমনটা করতে পারেন না। তাই যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের তিরস্কার সত্ত্বেও ট্রাম্প-এরদোয়ান সম্পর্ক দুর্দান্তভাবে ভালো কাটছে।এমনকি তুরস্ক যখন রাশিয়ার কাছ থেকে এস-৪০০ বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ক্রয় করেছিল তখনও ন্যাটো তুরস্কের বিরুদ্ধে যে নিষেধাজ্ঞা দিতে চেয়েছিল সেটিও থামান ডোনাল্ড ট্রাম্প। এদিকে মার্কিন নির্বাচনের আগে এরদোয়ান ট্রাম্পকে কথা দিয়েছিলেন কোনো ধরণের ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করবেন না। তবে গত সপ্তাহে তুরস্ক ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে একটি মহড়া পরিচালনা করেছিল। আবার বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে শক্তিশালি যুদ্ধ বিমান এফ-৩৫ তৈরির জন্য সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে তুরস্ক।এর প্রথম প্রস্তুতকারী ইসরাইল এবং যুক্তরাষ্ট্র এফ-৩৫ অন্য কোনো দেশের কাছে থাকুক তা চায় না। কারণ এটিকে তারা নিজেদের নিরাপত্তার জন্য হুমকি মনে করে। সাম্প্রতিক উত্তেজনার জেরে তুরস্ক ২০২১ সালের মধ্যে এফ-৩৫ যুদ্ধ বিমান তৈরির ঘোষণা দিয়েছে। একই সঙ্গে এটি তারা নিজস্ব প্রযুক্তিতে তৈরি করবে। ফলে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের তৈরি এফ-৩৫ এর চেয়ে বেশি শক্তিশালী হবে বলে মনে করা হচ্ছে তুরস্কের এ যুদ্ধ বিমান।আজারবাজান এবং আরমেনিয়ার যুদ্ধে তুরস্ক সেনা পাঠিয়ে সরাসরি হস্তক্ষেপ করে। তুরস্কের ড্রোনই যুদ্ধের ফল বদলে দিয়েছিল। কিন্তু ট্রাম্প এ বিষয়ে কোনো কথা বলেননি। যদিও ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ এবং রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন যুদ্ধ বিরতির জন্য বারবার আহ্বান জানিয়েছেন দু’পক্ষের প্রতি। সেখানে ট্রাম্প আলোচনায় বসার আহ্বান জানিয়েই দায় মুক্তি নিয়েছেন। মার্কিন নির্বাচনে নিউ ইয়র্ক, বোস্টন এবং লস এঞ্জেলে দেড় মিলিয়ন আজারবাইজানী ভোট পাওয়ার লোভে এই সংঘাতে ট্রাম্প চুপ ছিলেন। একই সঙ্গে এ সংঘাতে আনকারাকে কটাক্ষকরীদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেরন ট্রাম্প। কারণ তিনি তার বন্ধুকে (এরদোয়ান) রক্ষা করতে চান।একই সময়ে রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ বলেছেন, রাশিয়া কখনই তুরস্ককে কৌশলগত অংশিদার অথবা ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে দেখেনি। পুতিন ট্রাম্পকে পছন্দ করেন না। একই সঙ্গে তুরস্ক যখন মধ্যপ্রাচ্যে রাশিয়ার সঙ্গে ঘণিষ্ঠতা বাড়াচ্ছে তখন ট্রাম্প-এরদোয়ান ঘণিষ্ঠতা ভালোভাবে দেখেন না পুতিন। মার্কিন নির্বাচনের উত্তেজনা ইইউকে ভাবিয়ে তুলেছে। কারণ জো বাইডেন নির্বাচিত হলে তুরস্ক এবং যুক্তরাষ্ট্র শত্রুতা চরম পর্যায়ে পৌঁছাবে। তখন তুরস্ক শরণার্থীদের ইউরোপের দিকে ঠেলে দেবে। যেটি ইইউ কোনোভাবেই সামলাতে পারবে না। অন্যদিকে, ভূমধ্যসাগরে গ্রীস-তুরস্ক উত্তেজনাকে ওয়াশিংটনে বসেই সমাধান করতে হবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের। আর এই অঞ্চলে কোনোভাবেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে মাথাঘামাতে দেবে না আঙ্কারা।কিছুদিন আগে মন্ত্রিসভার একটি সম্মেলন শেষে এক সংবাদ সম্মেলনে এরদোয়ান বলেন, ‘সামরিক ষড়যন্ত্র, অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার ফাঁদ, অস্ত্র নিষেধাজ্ঞাসহ নানা কৌশলে আমাদের বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করা হয়েছিল। আমরা সব অপকৌশল ব্যর্থ করতে সক্ষম হয়েছি। গণতন্ত্রের পতাকাবাহী আন্তর্জাতিক অনেক সংস্থার আসল রূপ আমাদের সামনে উন্মোচিত হয়েছে। তুরস্ক আরও বড় এবং শক্তিশালী হচ্ছে। আমরা আমাদের লক্ষ্য থেকে বিচ্ছুত হবে না। সেটা হোক ইসরাইল-ফিলিস্তিন দ্বন্দ্ব, লিবিয়ার গৃহযুদ্ধ, আজারবাইজান-আর্মেনিয়া যুদ্ধ, ভূমধ্যসাগরে তেলের সন্ধান, সিরিয়ায় কুর্দিরা বা কাতারের সাথে প্রতিরক্ষা চুক্তি যাই হোক না কেন, তুরস্ক সব জায়গায় থাকবে। তুরস্ককে কেউ থামাতে পারবে না।’সাম্প্রতিক সময়ে অর্থনৈতিক সঙ্কট সত্ত্বেও এরদোয়ান তুরস্ককে এমন এক পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছেন যেখান থেকে দেশটি বিশ্বরাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এমন কি বর্তমানে রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপসহ বাঘাবাঘা শক্তিশালি দেশ ও অঞ্চলকে মোকা বেলা করতে প্রস্তুত তার দেশ। সৌদি আরবসহ যে সকল দেশ পশ্চিমা বিশ্বকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে তাদের মোকাবেলায় প্রস্তুত তুরস্ক। সৌদি যুবরাজ কর্তৃক সাংবাদিক জামাল খাশোগিকে হত্যার ঘটনায় সুস্পষ্ট বক্তব্য দিয়েছেন এরদোয়ান।এরপর সৌদি আরব তুরস্কের উপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। তবে এটিকে খুব একটা আমলে নিচ্ছেন না এরদোয়ান। যদিও সৌদি আরব তুরস্ককে গত একবছর যাবত বয়কট করে আসছে তবে এবার সেটি আরো বেশি কার্যকর হয়েছে। এখন নিষেধাজ্ঞা ব্যবসায়-বাণিজ্য, আমদানি-রপ্তানি এবং কি বেসামরিক নাগরিকদের মধ্যেও বলবৎ থাকবে।এই বর্জনের বিষয়ে এরদোয়ান কঠোর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেন, উপসাগরীয় এ দেশগুলো (সৌদি আরবসহ ইসরাইলের মিত্ররা) অতিতে ছিল না, আগামীতেও থাকবে না। তবে তুরস্ক ছিল, আছে এবং আগামীতেও তুরস্কের পতাকা আল্লাহর নামে উড়বে।ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্রকে তুরস্কের যতটা প্রয়োজন তার চেয়ে তুরস্কের কাছে তাদের প্রয়োজনটা বেশি। পুরাতন সব চুক্তি ও জোট ক্রমশ মূল্যহীন হয়ে পড়ছে। ক্ষমতার নতুন ভারসাম্য তৈরি হয়েছে। আর তুরস্ক বিশ্বে উদীয়মান তরকা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। তবে, আজারবাইজান-আর্মেনিয়া যুদ্ধ, ভূমধ্যসাগরে তুরস্ক এবং গ্রীস-সাইপ্রাসের যে দ্বন্দ্ব সেটি কেবল তেল গ্যাস পর্যন্ত সীমাবদ্ধ নেই। এটি আসলে এরদোয়ানের ‘নয়া তুরস্ক’ নীতি কতটা কার্যকর হবে তারও একটি পরীক্ষা বলা চলে।
Leave a Reply