এই সময়ে বিশ্বের সবচেয়ে জরুরি প্রয়োজনের একটি যন্ত্রের নাম ভেন্টিলেটর।করোনা মহামারি মোকাবেলায় বিশ্বজুড়ে হাসপাতালগুলোতে যথেষ্ট সংখ্যক ভেন্টিলেটর দিতে প্রচণ্ড চাপের মুখে রয়েছে অনেক দেশের সরকার।ঠিক সেই সময়ে বিশ্বখ্যাত মানের ভেন্টিলেটর তৈরি করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের উদ্যোগে সম্পৃক্ত হয়ে ওয়ালটন, মাইওয়ান, মিনিস্টারসহ কয়েকটি দেশীয় প্রযুক্তিপণ্য উৎপাদক কোম্পানি এই ভেন্টিলেটর তৈরি করবে।তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক নিজে এই উদ্যোগের সমন্বয় করছেন। সরকারি-বেসরকারি সংশ্লিষ্ট সব অংশীজনকে যার যার সক্ষমতা অনুযায়ী এই কার্যক্রমে সম্পৃক্ত করেছেন।
মঙ্গলবার (৩১ মার্চ) অনলাইন সংবাদ সম্মেলনে জুনাইদ আহমেদ পলক জানান, মঙ্গলবার দুপুরেই বিশ্বখ্যাত মেডিকেল প্রযুক্তিপণ্য উৎপাদক কোম্পানি মেডট্রোনিক ভেন্টিলেটর বানানোর সফটওয়্যার ও হার্ডওয়্যারের সোর্স কোড, ডিজাইনসহ পেটেন্ট তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের আরএনডি টিমকে দিয়েছে।‘এখন টেসলা, ফোর্ড, জেনারেল ইলেক্ট্রনিক্স ভেন্টিলেটর বানাতে যাচ্ছে। সেখানে মেডট্রোনিক বাংলাদেশকে শুধু পেটেন্ট নয় তাদের গবেষক ও প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের দিয়ে সবরকম সহায়তার হাত বাড়িয়েছে’ বলছিলেন তিনি।মেডট্রোনিকের প্রধান নির্বাহী ও চেয়ারম্যান ওমর ইশরাক বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত হওয়ার বাড়তি এই সহযোগিতা মিলছে। ওমর ইশরাক ইন্টেলেরও চেয়ারম্যান।মেডট্রোনিক আয়ারল্যান্ডের কোম্পানি, যার সদরদপ্তর আমেরিকার মেনিসোটায়। কোম্পানিটির মোট কর্মী ৯৮ হাজার এবং আয় ৩০ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার। বিশ্বের এই দু:সময়ে সব দেশের জন্য তাদের পেটেন্ট উম্মুক্ত করে দিয়েছে কোম্পানিটি।মেডট্রোনিকের পিবি৫৬০ মডেলের এই ভেন্টিলেটর দিয়ে সহজেই বয়ষ্ক ও শিশুদের সহজেই অক্সিজেন দেওয়া যাবে। এটি যেকোন পরিচর্যা কেন্দ্র বা বাসায় সহজেই ব্যবহারের উপযোগী।প্রতিমন্ত্রী জানান, ভেন্টিলেটর বানানোর এই উদ্যোগে ওয়ালটন, মাইওয়ান, সেলট্রন, এটুআই ইনোভেশন ল্যাব, এমআইএসটি, মিনিস্টার, স্টার্টআপ বাংলাদেশ, আইডিয়াকে প্রাথমিকভাবে যুক্ত করা হয়েছে। তবে দেশে কী পরিমাণ ভেন্টিলেটর উৎপাদন করা হবে, কবে নাগাদ বাজারে আসবে সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের উত্তরে প্রতিমন্ত্রী জানান, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আলোচনা চলছে। তবে কবে কখন এটির উৎপাদন শুরু হবে সেটা এখুনি বলা যাচ্ছে না। মেডট্রোনিক ও বাংলাদেশের গবেষকদের কয়েকটি টিম, উৎপাদক কোম্পানি লাগাতার কাজ করছে। বুধবারও এসব বিষয়ে সবাইকে নিয়ে বৈঠক-আলোচনা হবে, সেখানে মেডট্রোনিকের প্রতিনিধিরাও অংশ নেবেন। খুব শিগগিরই এ বিষয়ে ধারণা পাওয়া যাবে।‘ভেন্টিলেটর খুব স্পর্শকাতর একটি ডিভাইস। বিশ্বের অল্প কিছু কোম্পানি এটি প্রস্তুত করে থাকে। বাজারজাত করার আগে অনেকগুলো প্রক্রিয়ার বিষয় আছে। বৈশ্বিক বিভিন্ন সংস্থার অনুমোদন, পরীক্ষা ও সার্টিফিকেশন তারপর সেটি ব্যবহারের জন্য দেয়া হবে’ বলছিলেন পলক।জুম অ্যাপের মাধ্যমে করা এই ভিডিও সংবাদ সম্মেলনে সরাসরি যোগ দেন গণমাধ্যমকর্মীসহ দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের সরকারি-বেসরকারি ৫০ এর মতো অংশীজন।সংবাদ সম্মেলনে তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব এন এম জিয়াউল আলম বলেন, বাংলা টাইগার টিম মেডট্রোনিকের কাছ হতে ভেন্টিলেটরের পেটেন্ট বুঝে নিয়েছে। স্থানীয়ভাবে যেসব চ্যালেঞ্জ আসবে তা এই টিম সলভ করতে পারবে।
এটুআইয়ের পলিসি এডভাইজার আনীর চৌধুরী জানান, সারা পৃথিবীতে এখন ১০ লাখ ভেন্টিলেটরের চাহিদা। সে তুলনায় উৎপাদন সক্ষমতা ১০ ভাগের এক ভাগ। বাংলাদেশ যদি এটি উৎপাদন করতে পারে তাহলে দেশের চাহিদা মিটিয়ে বৈশ্বিক চাহিদা মেটাতেও ভূমিকা রাখতে পারবে। সেক্ষেত্রে দেশের অর্থনীতিতেও এই দু:সময়ে অবদান রাখা যাবে।‘এছাড়া ভেন্টিলেটরের মতো মেডিক্যাল ইক্যুপমেন্ট তৈরির যে ক্যাপাসিটি অর্জন করা যাবে সেটি বড় বিষয় হবে বাংলাদেশের জন্য’ বলেন তিনি।
সংবাদ সম্মেলনে এটুআই ইনোভেশন ল্যাবের হেড অব টেকনোলজি ফারুক আহমেদ জুয়েল জানান, দামের ক্ষেত্রে চায়নিজ ভেন্টিলেটর প্রকারভেদে ৭ লাখ হতে ১৯ লাখ টাকা আর ইউরোপের ভেন্টিলেটর ১৮ লাখ হতে ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত রয়েছে।‘দেশে উৎপাদিত ভেন্টিলেটর সেক্ষেত্রে অনেক কম দামের হতে পারে। সেটা আনুমানিক ২ লাখের মধ্যে থাকবে বলে মনে করছেন তারা। এই দাম ওয়ালটন বা উৎপাদনকারী কোম্পানির প্রফিট করার পর’ বলছিলেন তিনি।
ওয়ালটনের নির্বাহী পরিচালক ও কম্পিউটার বিভাগের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. লিয়াকত আলী বলেন, দেশে যে ডিজাইনের ভেন্টিলেটর উৎপাদনের কথা বলা হচ্ছে তা বেডের পাশে রাখা যাবে, গাড়িতে ব্যবহার করা যাবে মানে পোর্টেবল ও ব্যাটারিতেও চলবে।‘তারা মাল্টি লেয়ারের পিসিবিসহ ইলেক্ট্রনিক্স যন্ত্রপাতির বিভিন্ন কম্পোনেন্ট তৈরি করেন। তাদের ভেন্টিলেটর তৈরির সক্ষমতা রয়েছে। সেক্ষেত্রে একক ও একাধিক পোর্টের ব্যবহারযোগ্য ভেন্টিলেটর তারা করতে পারেন’ বলছিলেন তিনি।
সংবাদ সম্মেলনে এমআইএসটি নিজেদের ডিজাইন ও প্রযুক্তিতে ভেন্টিলেটর তৈরির কার্যক্রমের কথা জানায়।এমআইএসটির বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের বিভাগীয় প্রধান কর্নেল সাঈদ মাহফুজুর রাহমান জানান, তারা স্থানীয় প্রযুক্তিতে প্রোটোটাইপ তৈরি করেছেন। আমেরিকার ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের গাইডলাইন অনুসরণ করেই এটি তৈরি করা হয়েছে। ইতোমধ্যে ইতালির এবং ব্রাজিলের বায়োমেডিকেল বিশেষজ্ঞদের সায় পেয়েছেন।
শিগগিরই পরীক্ষার জন্য এই ভেন্টিলেটর প্রস্তুত করা যাবে বলে তারা আশা করছেন।কী এই ভেন্টিলেটর ?যেসব রোগীর করোনা সংক্রমণ খুবই মারাত্মক তাদের জীবনরক্ষায় ভেন্টিলেটর খুবই কার্যকর এক যন্ত্র।করোনাভাইরাসের প্রভাবে ফুসফুস অকার্যকর হয়ে গেলে শরীরের শ্বাস-প্রশ্বাস প্রক্রিয়া চালু রাখে যন্ত্রটি। এতে রোগটির সঙ্গে লড়াই করা যায়।কোভিড-১৯ রোগের চিকিৎসায় কয়েক ধরণের মেডিকেল ভেন্টিলেশন ব্যবহৃত হচ্ছে।বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, কোভিড-১৯ রোগে আক্রান্তদের মধ্যে ৮০ শতাংশ ব্যক্তির কোনো মেডিকেল ট্রিটমেন্ট দরকার হচ্ছে না। তারা এমনিই সুস্থ হয়ে উঠছেন। কিন্তু প্রতি ৬ জনে ১ জনের অবস্থা আশংকাজনক পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। তখন প্রয়োজন হচ্ছে ভেন্টিলেটর।
Leave a Reply