গত ২৮ মে নৃশংস হামলায় ২৬ বাংলাদেশি নিহত এবং ১১ বাংলাদেশি গুরুতর আহত হওয়ার ঘটনায় জড়িত দালাল চক্রের হোতা হাজি কামালকে রাজধানীর গুলশান এলাকা থেকে আটক করেছে র্যাব। পরে তাকে র্যাব হেফাজতে নিয়ে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ করায় বেরিয়ে আসছে একের পর এক চাঞ্চল্যকর তথ্য।
সোমবার (১ জুন) এক এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য তুলে ধরে র্যাব। বাহিনীটি জানায়, দালাল চক্রের হোতা হাজি কামাল গত ১০ বছরে তিনি ৪০০ জনেরও বেশি শ্রমিককে অবৈধভাবে লিবিয়ায় পাঠিয়েছেন। প্রতিজনের কাছ থেকে নিয়েছেন সাত/আট লাখ টাকা করে। করোনা পরিস্থিতির আগের মাসেই ৩৫ জন শ্রমিককে সেখানে পাঠানো হয়। রাজধানীতে প্রতিষ্ঠিত বড় বড় ছয়টি ব্যাংকে একাউন্ট আছে কামালের। তার ব্যাংক হিসাবে মিলেছে কোটি টাকা। যা তিনি মানব পাচার করে কামিয়েছেন। এবার প্রশ্ন উঠছে, কোন পথে মাসের পর মাস এভাবে শত শত শ্রমিককে বিদেশে পাঠিয়েছে এ চক্রটি। জিজ্ঞাসাবাদে এসব প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন দালাল চক্রের এ হোতা।
র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) বলছে, সংঘবদ্ধ চক্রটি বিদেশি চক্রের যোগসাজশে অবৈধভাবে বাংলদেশি নাগরিকদের বিভিন্ন দেশে পাঠিয়ে আসছে। এ সিন্ডিকেটটি তিনটি ধাপে কাজগুলো করে থাকে। (ক) বিদেশে যেতে আগ্রহী নির্বাচন। (খ) বাংলাদেশ থেকে লিবিয়ায় প্রেরণ। (গ) লিবিয়া থেকে ইউরোপে প্রেরণ। বিদেশে যেতে আগ্রহী নির্বাচন: বিদেশে গমনেচ্ছু নির্বাচনকালে এ চক্রের দেশীয় এজেন্টরা প্রত্যন্ত অঞ্চলের স্বল্প আয়ের মানুষদের অল্প খরচে উন্নত দেশে যাওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে আকৃষ্ট করে থাকেন। বিদেশ গমনেচ্ছুদের পাসপোর্ট তৈরি, ভিসা সংগ্রহ, টিকেট কেনাসহ এ সংক্রান্ত কার্যাবলী এ সিন্ডিকেটের তত্ত্বাবধানে সম্পন্ন হয়ে থাকে। পরে তাদের এককালীন বা ধাপে ধাপে কিস্তি নির্ধারণ করে ইউরোপের পথে পাড়ি দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়।
সিন্ডিকেটের সদস্যরা প্রার্থীদের সামর্থ্য অনুযায়ী ধাপ নির্বাচন করে থাকেন। ইউরোপ গমনের ক্ষেত্রে তারা সাত-আট লাখ টাকারও বেশি অর্থ নেওয়া হয়। বাংলাদেশ থেকে লিবিয়ায় প্রেরণ: বাংলাদেশ থেকে লিবিয়ায় পাঠানোর ক্ষেত্রে এ চক্রের সদস্যরা বেশ কয়েকটি রুট ব্যবহার করেন। রুটগুলো তারা সুযোগ সুবিধা অনুযায়ী মাঝে মধ্যে পরিবর্তন অথবা নতুন রুট নির্ধারণ করে থাকেন। সাম্প্রতিক সময়ে লিবিয়ায় পাঠাতে বাংলাদেশ-কলকাতা-মুম্বাই-দুবাই-মিশর-বেনগাজী-ত্রিপলি (লিবিয়া) রুট ব্যবহার করা হয়।
দুবাইয়ে পৌঁছে তাদের বিদেশি এজেন্টদের মাধ্যমে সাত-আট দিন অবস্থান করানো হয়। বেনগাজিতে পাঠানোর জন্য বেনগাজি থেকে এজেন্টরা কথিত ‘মরাকাপা’ নামক একটি ডকুমেন্ট দুবাইতে পাঠান। যা দুবাইয়ে অবস্থানরত বিদেশি এজেন্টদের মাধ্যমে ভিকটিমদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। পরে ডকুমেন্টসহ বিদেশি এজেন্ট তাদের মিশর ট্রানজিট নিয়ে বেনগাজি লিবিয়ায় পাঠান। বেনগাজিতে বাংলাদেশি এজেন্ট তাদের বেনগাজি থেকে ত্রিপলিতে স্থানান্তর করেন। শেষ ধাপ লিবিয়া থেকে ইউরোপে প্রেরণ: ভিকটিমরা ত্রিপলিতে পৌঁছানোর পর সেখানে অবস্থানরত বাংলাদেশি কথিত কয়েকজন এজেন্ট তাদের গ্রহণ করে থাকেন। তাদের ত্রিপলিতে বেশ কয়েকদিন অবস্থান করানো হয়। তারপর ত্রিপলিতে অবস্থানের সময় বর্ণিত এজেন্টদের দেশীয় প্রতিনিধির দ্বারা ভিকটিমদের আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে অর্থ আদায় করা হয়। এরপর ভিকটিমদের ত্রিপলির বন্দর এলাকায় একটি সিন্ডিকেটের কাছে অর্থের বিনিময়ে ইউরোপে পাচারের উদ্দেশে তাদের হস্তান্তর করা হয়।
এসময়ে সিন্ডিকেটটি সমুদ্রপথ অতিক্রম করার জন্য নৌ-যান চালনা এবং দিক নির্ণয়যন্ত্র পরিচালনাসহ আনুষঙ্গিক বিষয়ের ওপর নানাবিধ প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে। একটি নির্দিষ্ট দিনে ভোর রাতে এক সঙ্গে কয়েকটি নৌ-যান লিবিয়া হয়ে তিউনেশিয়া উপকূলীয় চ্যানেল হয়ে ইউরোপের পথে রওনা দেয়।
Leave a Reply